• বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২ আশ্বিন ১৪৩২
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

বিপ্লব, নাকি নব্য-ফ্যাসিবাদ

বিপ্লব, নাকি নব্য-ফ্যাসিবাদ

  আন্দোলন প্রতিবেদন  

রবিবার, ১১ মে ২০২৫  |  অনলাইন সংস্করণ

জুলাই-আগস্ট/২৪ অভ্যুত্থানের পর ৯ মাস পার হতে চলেছে। যারা বলেছিল এবং আন্তরিক সংগ্রামী তরুণদেরকে বুঝিয়েছিল যে, জুলাই-এ হাসিনার পতনে একটি বিপ্লব ঘটে গেছে, তারা তাদের সেই তথাকথিত বিপ্লব নিয়ে এক গোলচক্করে পড়ে গেছে।  

সরকারি ছাত্র-নেতা, তাদের ‘নতুন’ কিংস্ পার্টি নাপা ও কিছু ঘড়েল ও কিছু মূর্খ বুদ্ধিজীবী এখন আর অস্বীকার করতে পারছে না যে, তেমন একটা বিপ্লব ঘটেনি। তাই তারা সংস্কারের উপর ভর করেছে। কারণ, হাসিনা-ফ্যাসিবাদের প্রেসিডেন্ট, সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবী-সুশীল অনেকেই জায়গামতোই রয়ে গেছে। এমনকি হাসিনার সংবিধানটি পর্যন্ত এখনো অক্ষত। এগুলো তাদের জন্য হুমকি বৈকি– নিরাপত্তা ও ক্ষমতার জন্য। 

যেমন তারা কয়েকমাস ধরে বলা শুরু করেছে যে, ‘জুলাই বিপ্লব’-এর একটি ঘোষণাপত্র/চার্টার/প্রক্লেমেশন দিতে হবে। ‘বিপ্লব’ হয়ে ৯ মাস পার হয়ে গেছে; এখন তাদের মনে হচ্ছে একটা ঘোষণা দরকার! শুধু তাই নয়, এতোদিন পরে তাদের মনে হচ্ছে যে, বর্তমান সংবিধানটি ফ্যাসিবাদী, তাই তাকে বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনা করতে হবে। (যদিও এর অধীনেই তাদের ‘বিপ্লবী’ সরকারের শপথ হয়েছিল)।  

এখনো আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ পর্যন্ত তারা করেনি; কিন্তু আওয়ামী জয় বাংলা স্লোগান দিলে বা আওয়ামী লীগের মিছিল করলেই ধরে জেলে পুরতে হবে। এমনকি দেশে তাদেরই দখলে থাকা আইন-আদালত-পুলিশের সামনেই কয়েকদিন ধরে শেখ মুজিবের বাড়ি ভাঙার মচ্ছব চলেছে, যথেচ্ছ লুটপাটও করা হয়েছে। সুযোগ মতো পেলে আওয়ামী ছিঁচকে সন্ত্রাসীদের পিটিয়ে মেরেও ফেলা হয়েছে (মব জাস্টিস)। 

অথচ, অভ্যুত্থানের তুঙ্গ মুহূর্তে যখন নিভর্ীক জনতা হাসিনার ফ্যাসিবাদী বহুবিধ প্রতিষ্ঠান ও নেতাদের উপর বিপ্লবী কায়দায় হামলা করেছিলেন তখন তাকে এরা প্রকাশ্যে নিন্দা করেছিল; তথাকথিত “শান্তিপূর্ণ” আন্দোলনের নসিহত করেছিল।  

এটা তো বোঝা খুব কঠিন নয় যে, ঠিক ৫ আগস্টেই অভ্যুত্থানের ফসল যেভাবে চুরি হয়ে গিয়েছিল তাতে এইসব নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা সক্রিয়ভাবে হাত মিলিয়েছিল। যারা আজ হাসিনার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলছে তারা কি দেখেনি যে, তাদের সমর্থিত সরকার শপথ নিয়েছিল হাসিনার অনুগত, রাষ্ট্রের দুই প্রধান পদাধিকারী ব্যক্তি, প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধানের অধীনে ও আহ্বানে, তাদেরই সংবিধান ঊর্ধ্বে রাখার শপথ নিয়ে? 

জনগণ নিশ্চয়ই এক সহিংস অভ্যুত্থান করেছিলেন। কিন্তু তথাকথিত অরাজনৈতিক ভূঁইফোড় ছাত্রনেতাদের একাংশের এবং বুর্জোয়া পার্টিগুলোর চক্রান্তে এতে কোনো বিপ্লবী কর্মসূচি আসতে পারেনি। ফলে কোনো বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতৃত্ব না থাকায় বিপ্লব দূরের কথা, খোদ অভ্যুত্থানটিই সম্পূর্ণ হতে পারেনি। এটি বাস্তবে এক অসম্পূর্ণ গণঅভ্যূত্থান।  

* এখন তাদের বিপ্লবের স্লোগানও চলছে, সংস্কার কর্মসূচির ধুয়াও চলছে। কিন্তু এই সংস্কার নিয়েও চলছে হাজারো রকমের ষড়যন্ত্র। মতপার্থক্য তো প্রকাশ্যেই চলে এসেছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যেখানে শ্রেণিগত কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, রাষ্ট্রযন্ত্র যখন অক্ষত, তখন সংবিধান, রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান, আমলাতন্ত্র, ভারত, আওয়ামী লীগ– এসবের উচ্ছেদ নিয়ে বড় বড় বিপ্লবী বুলি আওড়ানোর পেছনের  রাজনীতিটা কী? হাসিনা-আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী, এ সত্য এখন প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যারা বিপ্লব না করে, বিপ্লবের কোনো কর্মসূচি না এনে শুধু আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে চাইছে, আর সেই সুযোগে নিজেদের আখের গুছাতে ব্যস্ত, তাদের রাজনীতিটা কী? 

নিপীড়িত জনগণের মূল অংশ হলেন শ্রমিক, কৃষক, শ্রমজীবী, দরিদ্র মানুষ। যাদের মিত্র হলেন জাতিগত সংখ্যালঘু ও নিপীড়িত নারী-আদিবাসী-সাধারণ মধ্যবিত্তসহ ব্যাপক জনগণ। জুলাই অভ্যুত্থানে এই জনগণ যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারেননি তাতো স্বতঃস্পষ্ট। এমনকি জুলাই অভ্যুত্থানে এই জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা দূরের কথা, তাদের মৌলিক কোনো দাবি পর্যন্ত স্বঘোষিত নেতারা তুলে ধরেনি ও এতো মাস পরেও তার কিছুই বাস্তবায়ন করেনি। 

তাহলে এখন যারা প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র-ক্ষমতার অংশ হয়ে বিপ্লব বিপ্লব খেলা চালাতে চাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যটা কী? 

প্রথমত, তাদের রয়েছে ‘বিরাজনীতিকরণ’-এর একটা কর্মসূচি, যার কেন্দ্রীয় বিষয় হলো, জনগণকে, বিশেষত ছাত্র-তরুণ ও শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি করার অধিকার হরণ করা (দেখা যেতে পারে, বুয়েট ও কুয়েটে কী হয়েছে)। এটা আওয়ামী-বিএনপি-জামাত-জাপার গণবিচ্ছিন্নতার সুযোগে একটি জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি, যা সারমর্মে ফ্যাসিবাদ। দ্বিতীয়ত, নিজেদের গোষ্ঠীগত ক্ষমতাকে স্থায়ী করার জন্য দেশের প্রধান দুই বুর্জোয়া পার্টিকে খারিজ করা, যেহেতু তারাই এই তৃতীয় শক্তির ক্ষমতার পথে প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী। এটাও বুর্জোয়া গণতন্ত্র নয়, বরং ফ্যাসিবাদেরই বৈশিষ্ট্য।   

তৃতীয় শক্তি বা নাপার মতো “বিপ্লবী” পার্টিগুলোর এখনো তেমন একটা বড় সাংগঠনিক শক্তি নেই। তাই, তাদের সময় দরকার। তারা আশা করছে, বাস্তবে ঘটছেও কিছুটা, সময় পেলে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে তারা পার্টিটাকে গড়ে নিতে পারবে। অন্তত ঘাসমূলে আওয়ামী লুটেরারা তাদের দলে ভিড়বে, কারণ আওয়ামীদেরকে দমনে রেখেই তা সম্ভব। তাদের বিরুদ্ধে বিশাল অফিস, দেড়শ’ গাড়ির বহর, ৭০টি অভ্যর্থনা গেট, কোটি টাকার দামি গাড়ি, এমনকি দুর্নীতির যেসব অভিযোগ উঠছে সেগুলো একেবারে স্বাভাবিক ঘটনা। তারা চলমান ব্যবস্থার সেবক ও বুর্জোয়া পার্টি হয়ে উঠছে। তারা যে বিপ্লবী নয়, বরং বিপ্লবের নামে একটা বোগাস-গ্রুপ তা এসবেও প্রমাণ হচ্ছে, দিন দিন আরো প্রমাণিত হবে।

 তাদের প্রয়োজন হচ্ছে বিপ্লবের নামে নব্য-ফ্যাসিবাদের বীজ বোনা। এরই অংশ হলো কিছু বিপ্লবী ধরনের বোলচাল– প্রক্লেমেশন, দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র, সংবিধান বাতিল, গণপরিষদ নির্বাচন, ফ্যাসিবাদ-নির্মূল স্লোগান– ইত্যাদি। 

অথচ একইসাথে দেখুন, যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মুখে এতোটা সোচ্চার, তারা কিনা এদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ফ্যাসিবাদী ’৭১-এর গণহত্যার সহযোগী জামাতের সাথে কেমন মাখামাখিটাই না করছে। ধর্মবাদী ফ্যাসিবাদীদের মদদ দিচ্ছে। বিরাজনীতিকরণকে বাতাস দিচ্ছে। বুর্জোয়া নির্বাচনকেও বিবিধ অজুহাতে ঠেকিয়ে রাখছে। 

বিপ্লবী রাজনীতির অবস্থান থেকে আওয়ামী নিষিদ্ধ দাবি, সংবিধান বাতিল– ইত্যাদি অবশ্যই ন্যায্য। কিন্তু সেসব করার জন্য প্রথম প্রয়োজন একটি প্রকৃত গণ-বিপ্লব, জনগণের শত্রু সাম্রাজ্যবাদ, ভারত ও তাদের দালাল বড় বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ এবং বিপ্লবী শ্রেণি ও জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠা। যা কিনা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, গোটা শাসকশ্রেণিটিকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে। আপনারা সেটা করবেন না, আর বিপ্লবী বুলি আওড়াবেন। একে মারবেন, ওকে ধরবেন। এটা শাসকশ্রেণির নিজেদের মধ্যকার গোষ্ঠীগত কোন্দলে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে অপর পক্ষকে দমন করার কৌশল ব্যতীত আর কিছু নয়।  হাসিনা-আওয়ামী লীগ সেটাই করেছিল।  

আন্তর্জাতিকভাবে ও ইতিহাসে এর প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েূছে। হিটলার ও মুসোলিনি খুবই জনপ্রিয় ছিল। তারা নির্বাচনে জিতে গণরায় নিয়েই ক্ষমতায় গিয়েছিল। তারা শ্রমিক শ্রেণি ও সমাজতন্ত্রের কথাও বলেছিল। কিন্তু তাদের মূল রাজনীতি যে ছিল ফ্যাসিবাদী– বুর্জোয়া রাজনীতির নিকৃষ্টতম ভার্সান– তা প্রথম দিকে শুধুমাত্র স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রীরাই উদ্ঘাটন করেছিলেন। ইতিহাস দেখেছে সমাজতন্ত্রীদের মূল্যায়ন কতটা সঠিক ছিল। 

বাস্তবে তৃতীয় শক্তির যেসব রাজনৈতিক কৌশল– আগে সংস্কার পরে নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার না করে নির্বাচন নয়– ইত্যাদিকে জামাত-চক্রান্তকারীরাও যে সমর্থন করছে তা বিনা কারণে নয়। উভয়ে উভয়কে ব্যবহার করতে চাইছে।  

সুতরাং, নব্য-ফ্যাসিবাদী ও ধর্মবাদী ফ্যাসিস্টদের বিপ্লবী ও জনতুষ্টিবাদী হাঁকডাকে বিভ্রান্ত না হয়ে সংগ্রামী ও গণতন্ত্রমনা ছাত্র-তরুণ ও জনগণকে প্রকৃত বিপ্লবী রাজনীতিতে সচেতন ও সংগঠিত হতে হবে। পতিত আওয়ামী-ভারত ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করার পাশাপাশি তাদেরকে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার মদদপ্রাপ্ত বিকাশমান নব্য-ফ্যাসিবাদ সম্পর্কেও অতিমাত্রায় সতর্ক হতে হবে।

বিপ্লব, নাকি নব্য-ফ্যাসিবাদ

 আন্দোলন প্রতিবেদন 
রবিবার, ১১ মে ২০২৫  |  অনলাইন সংস্করণ

জুলাই-আগস্ট/২৪ অভ্যুত্থানের পর ৯ মাস পার হতে চলেছে। যারা বলেছিল এবং আন্তরিক সংগ্রামী তরুণদেরকে বুঝিয়েছিল যে, জুলাই-এ হাসিনার পতনে একটি বিপ্লব ঘটে গেছে, তারা তাদের সেই তথাকথিত বিপ্লব নিয়ে এক গোলচক্করে পড়ে গেছে।  

সরকারি ছাত্র-নেতা, তাদের ‘নতুন’ কিংস্ পার্টি নাপা ও কিছু ঘড়েল ও কিছু মূর্খ বুদ্ধিজীবী এখন আর অস্বীকার করতে পারছে না যে, তেমন একটা বিপ্লব ঘটেনি। তাই তারা সংস্কারের উপর ভর করেছে। কারণ, হাসিনা-ফ্যাসিবাদের প্রেসিডেন্ট, সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবী-সুশীল অনেকেই জায়গামতোই রয়ে গেছে। এমনকি হাসিনার সংবিধানটি পর্যন্ত এখনো অক্ষত। এগুলো তাদের জন্য হুমকি বৈকি– নিরাপত্তা ও ক্ষমতার জন্য। 

যেমন তারা কয়েকমাস ধরে বলা শুরু করেছে যে, ‘জুলাই বিপ্লব’-এর একটি ঘোষণাপত্র/চার্টার/প্রক্লেমেশন দিতে হবে। ‘বিপ্লব’ হয়ে ৯ মাস পার হয়ে গেছে; এখন তাদের মনে হচ্ছে একটা ঘোষণা দরকার! শুধু তাই নয়, এতোদিন পরে তাদের মনে হচ্ছে যে, বর্তমান সংবিধানটি ফ্যাসিবাদী, তাই তাকে বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনা করতে হবে। (যদিও এর অধীনেই তাদের ‘বিপ্লবী’ সরকারের শপথ হয়েছিল)।  

এখনো আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ পর্যন্ত তারা করেনি; কিন্তু আওয়ামী জয় বাংলা স্লোগান দিলে বা আওয়ামী লীগের মিছিল করলেই ধরে জেলে পুরতে হবে। এমনকি দেশে তাদেরই দখলে থাকা আইন-আদালত-পুলিশের সামনেই কয়েকদিন ধরে শেখ মুজিবের বাড়ি ভাঙার মচ্ছব চলেছে, যথেচ্ছ লুটপাটও করা হয়েছে। সুযোগ মতো পেলে আওয়ামী ছিঁচকে সন্ত্রাসীদের পিটিয়ে মেরেও ফেলা হয়েছে (মব জাস্টিস)। 

অথচ, অভ্যুত্থানের তুঙ্গ মুহূর্তে যখন নিভর্ীক জনতা হাসিনার ফ্যাসিবাদী বহুবিধ প্রতিষ্ঠান ও নেতাদের উপর বিপ্লবী কায়দায় হামলা করেছিলেন তখন তাকে এরা প্রকাশ্যে নিন্দা করেছিল; তথাকথিত “শান্তিপূর্ণ” আন্দোলনের নসিহত করেছিল।  

এটা তো বোঝা খুব কঠিন নয় যে, ঠিক ৫ আগস্টেই অভ্যুত্থানের ফসল যেভাবে চুরি হয়ে গিয়েছিল তাতে এইসব নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা সক্রিয়ভাবে হাত মিলিয়েছিল। যারা আজ হাসিনার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলছে তারা কি দেখেনি যে, তাদের সমর্থিত সরকার শপথ নিয়েছিল হাসিনার অনুগত, রাষ্ট্রের দুই প্রধান পদাধিকারী ব্যক্তি, প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধানের অধীনে ও আহ্বানে, তাদেরই সংবিধান ঊর্ধ্বে রাখার শপথ নিয়ে? 

জনগণ নিশ্চয়ই এক সহিংস অভ্যুত্থান করেছিলেন। কিন্তু তথাকথিত অরাজনৈতিক ভূঁইফোড় ছাত্রনেতাদের একাংশের এবং বুর্জোয়া পার্টিগুলোর চক্রান্তে এতে কোনো বিপ্লবী কর্মসূচি আসতে পারেনি। ফলে কোনো বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতৃত্ব না থাকায় বিপ্লব দূরের কথা, খোদ অভ্যুত্থানটিই সম্পূর্ণ হতে পারেনি। এটি বাস্তবে এক অসম্পূর্ণ গণঅভ্যূত্থান।  

* এখন তাদের বিপ্লবের স্লোগানও চলছে, সংস্কার কর্মসূচির ধুয়াও চলছে। কিন্তু এই সংস্কার নিয়েও চলছে হাজারো রকমের ষড়যন্ত্র। মতপার্থক্য তো প্রকাশ্যেই চলে এসেছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যেখানে শ্রেণিগত কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, রাষ্ট্রযন্ত্র যখন অক্ষত, তখন সংবিধান, রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান, আমলাতন্ত্র, ভারত, আওয়ামী লীগ– এসবের উচ্ছেদ নিয়ে বড় বড় বিপ্লবী বুলি আওড়ানোর পেছনের  রাজনীতিটা কী? হাসিনা-আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী, এ সত্য এখন প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যারা বিপ্লব না করে, বিপ্লবের কোনো কর্মসূচি না এনে শুধু আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে চাইছে, আর সেই সুযোগে নিজেদের আখের গুছাতে ব্যস্ত, তাদের রাজনীতিটা কী? 

নিপীড়িত জনগণের মূল অংশ হলেন শ্রমিক, কৃষক, শ্রমজীবী, দরিদ্র মানুষ। যাদের মিত্র হলেন জাতিগত সংখ্যালঘু ও নিপীড়িত নারী-আদিবাসী-সাধারণ মধ্যবিত্তসহ ব্যাপক জনগণ। জুলাই অভ্যুত্থানে এই জনগণ যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারেননি তাতো স্বতঃস্পষ্ট। এমনকি জুলাই অভ্যুত্থানে এই জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা দূরের কথা, তাদের মৌলিক কোনো দাবি পর্যন্ত স্বঘোষিত নেতারা তুলে ধরেনি ও এতো মাস পরেও তার কিছুই বাস্তবায়ন করেনি। 

তাহলে এখন যারা প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র-ক্ষমতার অংশ হয়ে বিপ্লব বিপ্লব খেলা চালাতে চাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যটা কী? 

প্রথমত, তাদের রয়েছে ‘বিরাজনীতিকরণ’-এর একটা কর্মসূচি, যার কেন্দ্রীয় বিষয় হলো, জনগণকে, বিশেষত ছাত্র-তরুণ ও শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি করার অধিকার হরণ করা (দেখা যেতে পারে, বুয়েট ও কুয়েটে কী হয়েছে)। এটা আওয়ামী-বিএনপি-জামাত-জাপার গণবিচ্ছিন্নতার সুযোগে একটি জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি, যা সারমর্মে ফ্যাসিবাদ। দ্বিতীয়ত, নিজেদের গোষ্ঠীগত ক্ষমতাকে স্থায়ী করার জন্য দেশের প্রধান দুই বুর্জোয়া পার্টিকে খারিজ করা, যেহেতু তারাই এই তৃতীয় শক্তির ক্ষমতার পথে প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী। এটাও বুর্জোয়া গণতন্ত্র নয়, বরং ফ্যাসিবাদেরই বৈশিষ্ট্য।   

তৃতীয় শক্তি বা নাপার মতো “বিপ্লবী” পার্টিগুলোর এখনো তেমন একটা বড় সাংগঠনিক শক্তি নেই। তাই, তাদের সময় দরকার। তারা আশা করছে, বাস্তবে ঘটছেও কিছুটা, সময় পেলে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে তারা পার্টিটাকে গড়ে নিতে পারবে। অন্তত ঘাসমূলে আওয়ামী লুটেরারা তাদের দলে ভিড়বে, কারণ আওয়ামীদেরকে দমনে রেখেই তা সম্ভব। তাদের বিরুদ্ধে বিশাল অফিস, দেড়শ’ গাড়ির বহর, ৭০টি অভ্যর্থনা গেট, কোটি টাকার দামি গাড়ি, এমনকি দুর্নীতির যেসব অভিযোগ উঠছে সেগুলো একেবারে স্বাভাবিক ঘটনা। তারা চলমান ব্যবস্থার সেবক ও বুর্জোয়া পার্টি হয়ে উঠছে। তারা যে বিপ্লবী নয়, বরং বিপ্লবের নামে একটা বোগাস-গ্রুপ তা এসবেও প্রমাণ হচ্ছে, দিন দিন আরো প্রমাণিত হবে।

 তাদের প্রয়োজন হচ্ছে বিপ্লবের নামে নব্য-ফ্যাসিবাদের বীজ বোনা। এরই অংশ হলো কিছু বিপ্লবী ধরনের বোলচাল– প্রক্লেমেশন, দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র, সংবিধান বাতিল, গণপরিষদ নির্বাচন, ফ্যাসিবাদ-নির্মূল স্লোগান– ইত্যাদি। 

অথচ একইসাথে দেখুন, যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মুখে এতোটা সোচ্চার, তারা কিনা এদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ফ্যাসিবাদী ’৭১-এর গণহত্যার সহযোগী জামাতের সাথে কেমন মাখামাখিটাই না করছে। ধর্মবাদী ফ্যাসিবাদীদের মদদ দিচ্ছে। বিরাজনীতিকরণকে বাতাস দিচ্ছে। বুর্জোয়া নির্বাচনকেও বিবিধ অজুহাতে ঠেকিয়ে রাখছে। 

বিপ্লবী রাজনীতির অবস্থান থেকে আওয়ামী নিষিদ্ধ দাবি, সংবিধান বাতিল– ইত্যাদি অবশ্যই ন্যায্য। কিন্তু সেসব করার জন্য প্রথম প্রয়োজন একটি প্রকৃত গণ-বিপ্লব, জনগণের শত্রু সাম্রাজ্যবাদ, ভারত ও তাদের দালাল বড় বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ এবং বিপ্লবী শ্রেণি ও জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠা। যা কিনা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, গোটা শাসকশ্রেণিটিকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে। আপনারা সেটা করবেন না, আর বিপ্লবী বুলি আওড়াবেন। একে মারবেন, ওকে ধরবেন। এটা শাসকশ্রেণির নিজেদের মধ্যকার গোষ্ঠীগত কোন্দলে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে অপর পক্ষকে দমন করার কৌশল ব্যতীত আর কিছু নয়।  হাসিনা-আওয়ামী লীগ সেটাই করেছিল।  

আন্তর্জাতিকভাবে ও ইতিহাসে এর প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েূছে। হিটলার ও মুসোলিনি খুবই জনপ্রিয় ছিল। তারা নির্বাচনে জিতে গণরায় নিয়েই ক্ষমতায় গিয়েছিল। তারা শ্রমিক শ্রেণি ও সমাজতন্ত্রের কথাও বলেছিল। কিন্তু তাদের মূল রাজনীতি যে ছিল ফ্যাসিবাদী– বুর্জোয়া রাজনীতির নিকৃষ্টতম ভার্সান– তা প্রথম দিকে শুধুমাত্র স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রীরাই উদ্ঘাটন করেছিলেন। ইতিহাস দেখেছে সমাজতন্ত্রীদের মূল্যায়ন কতটা সঠিক ছিল। 

বাস্তবে তৃতীয় শক্তির যেসব রাজনৈতিক কৌশল– আগে সংস্কার পরে নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার না করে নির্বাচন নয়– ইত্যাদিকে জামাত-চক্রান্তকারীরাও যে সমর্থন করছে তা বিনা কারণে নয়। উভয়ে উভয়কে ব্যবহার করতে চাইছে।  

সুতরাং, নব্য-ফ্যাসিবাদী ও ধর্মবাদী ফ্যাসিস্টদের বিপ্লবী ও জনতুষ্টিবাদী হাঁকডাকে বিভ্রান্ত না হয়ে সংগ্রামী ও গণতন্ত্রমনা ছাত্র-তরুণ ও জনগণকে প্রকৃত বিপ্লবী রাজনীতিতে সচেতন ও সংগঠিত হতে হবে। পতিত আওয়ামী-ভারত ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করার পাশাপাশি তাদেরকে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার মদদপ্রাপ্ত বিকাশমান নব্য-ফ্যাসিবাদ সম্পর্কেও অতিমাত্রায় সতর্ক হতে হবে।

আরও খবর
 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র